করোনাভাইরাস এর সংকটের মধ্যে টিকা প্রদান:
টিকা দিয়ে প্রতিরোধ করা যায় এমন সব রোগ সমূহের হাত থেকে শিশুদেরকে রক্ষা করার জন্য নদী ও কচুরিপানার মধ্য দিয়ে হেঁটে দুর্গম এক পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকায় পৌঁছেন স্বাস্থ্যকর্মী বিণা রানী।
বিণা রানী বাংলাদেশের একজন সরকারি স্বাস্থ্যকর্মী। তার বয়স ৫০ বছর। শিশু ও গর্ভবতী মায়েদেরকে টিকা নিশ্চিত করতে বীণা রাণী ছুটে চলেন মাইলের পর মাইল। তিনি কাজ করেন বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলার একটি অতি প্রত্যন্ত এলাকায়।
তিনি যক্ষ্মা প্রতিরোধের জন্য বি.সি.জি টিকা প্রদান করে থাকেন। এছাড়া তিনি ডিপথেরিয়া, ধনুষ্টঙ্কার ও হুপিং কাশি, হেপাটাইটিস বি, হ্যামোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা বি, নিউমোকোকাস, পোলিও এবং হাম ও রুবেলার টিকা প্রদান করে থাকপন স্বাস্থ্যকর্মী বিণা রাণী। বাংলাদেশে লকডাউনের ঘোষণা ও শারীরিক দূরত্ব রক্ষার করার নির্দেশনার মধ্যেই বিণা রাণী অন্য সকল স্বাস্থ্যকর্মীদের মতোই করোনাভাইরাস এর সংকটের মধ্যে টিকা প্রদান এই কাজটি করে চলেছেন।
বাংলাদেশে বর্ষাকাল ও বৃষ্টি শুরুর আগেই তিনি হেঁটে হেঁটে টিকা প্রদানের কষ্টসাধ্য কাজটি করে চলেছেন অবিরত ।
“আমাদের উৎসাহের কোনো ঘাটতি নেই”
শুধু করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে পরিস্থিতি জটিল হওয়াতে নয়, বরং বিণা রানীর কাজটি সব সময়ই অনেক চ্যালেঞ্জিং। কারণ তিনি প্রত্যন্ত একটি এলাকায় কাজ করে থাকেন।
প্রতি মাসে আমাকে যে করেই হোক না কেনো আটটি কেন্দ্রে টিকা পৌঁছে দিতে হয়। দুইটি কেন্দ্র যেতে হয় নদী পেরিয়ে এবং কচুরিপানার মধ্য দিয়ে আমাকে হেঁটে যেতে হয় এই দূর্গম পথ – বলেন বিণা রাণী। তিনি আরও বলেন যে, “কাজটি শারীরিকভাবে অনেক কষ্টসাধ্য ও খুবই ক্লান্তিকর। তবে আমাদের একজনও স্বাস্থ্যকর্মী খুঁজে পাবেন না, যার মধ্যে এই কাজটি করার জন্য উৎসাহের কোনো ঘাটতি রয়েছে।”
কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে সকল ধরনের গণপরিবহন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে আমরা আট কিলোমিটারের এই দূর্গম পথ পায়ে হেঁটে গিয়ে একদম শেষ প্রান্তের টিকাদান কেন্দ্রে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত এবং ওই আট কিলোমিটার পথ হেঁটেই আবার বাড়িতে ফিরতে হচ্ছে আমাদেরকে প্রতিনিয়ত । সেখানে যাতায়াতের জন্য কোনো নৌকার ব্যবস্থা নেই, এমনকি বাসও নেই- বলেন বিণা রানী।
শিশুদের সু-স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে বিণা রাণীর এই বিশেষ ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ , স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, বাংলাদেশে টিকা প্রদান ব্যবস্থার যদি উন্নতি না হয় তাহলে, হাম ও অন্যান্য মারাত্মক অসুখ গুলো গুরুতর আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে। ২০২০ সালের শুরুতে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে টিকা প্রদানের লক্ষ্য অর্জনের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু কোভিড-১৯ সংকট ও করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে টিকাদান কর্মসূচি স্থগিত করতে হয়েছে ।
মা-বাবাদের মধ্যে অনাগ্রহ
বাংলাদেশের মধ্যে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচিতে কারিগরি ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে ইউনিসেফ। কিন্তু কোভিড-১৯ এর কারণে নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচী মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে সন্তানদেরকে নিয়মিত টিকা দেওয়ার জন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নেওয়ার ব্যাপারে মা-বাবাদের মধ্যে অনাগ্রহ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশ সরকার জাতীয় হাম ও রুবেলা রোগের টিকাদান কর্মসূচির আওতায় ৯ মাস থেকে ৯ বছর বয়সী সর্বমোট ৩ কোটি ৪০ লাখ শিশুকে টিকা দেওয়ার লক্ষ্য অর্জনের যে কর্মসূচিটি ছিলো সেটি স্থগিত করার পরপরই দেশের কিছু কিছু স্থানে হামের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সম্প্রতি এই বিষয়টি নিয়ে ইউনিসেফ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক উপদেষ্টাদের পরামর্শ মতে কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যেও নিয়মিত টিকা প্রদান বিষয়ে একটি নির্দেশনা জারি করেছে সরকার। নির্দেশনায় বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে এবং টিকাদানের বিষয়টি স্থায়ী ও প্রচারণা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু দেশের যেসব এলাকায় লকডাউন চলছে, সে সমস্ত এলাকায় শিশুরা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে না আসায় টিকা প্রদান উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে।
বিণা রানীর মতে টিকার সুফল সম্পর্কে সাধারণত দরিদ্র মানুষদেরকে বোঝানোর প্রয়োজন পড়ে না তেমন, বরং যারা ধনী মানুষ তাদের মধ্যেই টিকা প্রদানের ব্যাপারে অনেক অনিহা রয়েছে। ‘আমরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাদেরকে টিকা নিতে উৎসাহিত করার চেষ্টা করে চলেছি। আমরা তাদের বাড়িতে যাই এবং শারীরিক দূরত্ব রক্ষা করেই আমরা তাদের বোঝনোর চেষ্টা করি। এই সময়ে শিশুদেরকে টিকা দেওয়াটা যে নিরাপদ সেটিও আমরা তাদেরকে ব্যাখ্যা করছি’- বলেন স্বাস্থ্যকর্মী বিণা রানী।
মাইকে তার আগমণ ঘোষণা
অপ্রতিরোধ্য স্বাস্থ্যকর্মী বিণা রাণী জানান, কোভিড-১৯ নিয়ে তার ওই এলাকায় মানুষদের মধ্যে এখনো তেমন কোনো ভয় লক্ষ করা যাচ্ছে না। তবে অন্যান্য রোগের কিছু টিকার বেশ ঘাটতি দেখা দিয়েছে ইতিমধ্যে। তিনি বলেন, ‘এমন নজিরও এখানে রয়েছে যে, অনেক মা-বাবা তাদের সন্তানদেরকে টিকা দেওয়ার জন্য এই মহামারী পরিস্থিতি ভালো হওয়ার অপেক্ষা করছেন। কিন্তু আমরা তাদেরকে বলছি যে, তাতে করে অনেক দেরি হয়ে যেতে পারে।
‘এছাড়া আমরা টিকাদান শুরুর বিষয়টি পূর্বেই মাইকে ঘোষণা করার জন্য স্থানীয় সকল মসজিদের ইমামদেরকে অনুরোধ করি, যাতে গ্রামের কেউই টিকাদানের খবরটি পাওয়া থেকে বাদ না পড়ে’- বলেন বিণা রানী।
তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে মা-বাবারা উদ্বিগ্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা তাদেরকে দেখানোর চেষ্টা করি যে, ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী পরে এবং সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করেই আমরা আমাদের কাজ চালিয়ে যেতে পারি।
আরও এমন স্যাস্থ বিষয়ক তথ্য জানতে ভিজিট করুন এখানে . . .