আলীকদম, কুতুবদিয়া, কক্সবাজার

আলীকদম যাওয়ার পরিকল্পনাটা হঠাৎ করেই হয়। শুক্রবারে বন্ধের দিনে আমাদের তিন বন্ধুর ঢাকার আশেপাশে কোথাও থেকে বেরিয়ে আসার কথা ছিল। কিন্তু মঙ্গলবার একজন বলল কাজের চেপে সে কোথাও যেতে পারবে না আর বুধবার অন্যজন বলল তার অফিস থেকে ছুটি ম্যানেজ হয়েছে শনি-রবি আরও দুই দিনের। দুই জনের দুই উল্টো পথে যাত্রা 😂। ছুটি যেহেতু পাওয়া গেছে তাই আমরা দুই জনই কোথাও থেকে ঘুরে আসব ঠিক করলাম, একটু দূরে কোথাও যাব। গন্তব্য ঠিক হল আলীকদম আর কুতুবদিয়া। পরিকল্পনা হল ১ম দিন আলীকদম এ ট্র্যাকিং করে আলীর সুড়ঙ্গ দেখব, তারপর দুইদিন কুতুবদিয়ার শান্ত, নির্জন আর কোলাহল মুক্ত সমুদ্র সৈকতে বিশ্রাম নিয়ে ঢাকার পথ ধরব।

ভরা পর্যটন মৌসুম হওয়ায় আর হাতে সময় খুব কম থাকায় প্রথমেই টিকেট পাওয়া নিয়ে বেশ ঝামেলায় পরতে হয়। খরচ আর সময় এর কথা চিন্তা করে আমরা ঠিক করেছিলাম চকরিয়া হয়ে আলীকদম যাব। যদিও থানচি থেকে ডিম পাহাড় হয়ে বাংলাদেশের সব থেকে উঁচু রাস্তা দিয়ে মোটরবাইকে করে আলীকদম যাওয়া আরও বেশি উপভোগ্য হতো, কিন্তুু আলীর সুড়ঙ্গে ঠিক কতটা সময় লাগবে সম্পূর্ণটা ভালভাবে ঘুরে দেখতে তা না জানায় এই পরিকল্পনা বাদ দিই, বরং সহজ আর কম সময়ে যাওয়ার জন্য চকরিয়ার পথটাই বেছে নিই। কিন্তু এই রুটের কোন বাসেই সিট পাচ্ছিলাম না। পরে এস আলম পরিবহনের রাত ১১ টার বাসে একদম সামনের দুটি সিট পেয়ে যাই। আলোতে ঘুমাতে কষ্ট হবে জেনেও এই সিট গুলো ই আমরা নিয়ে নিই।

পরদিন আমাদের যাত্রা শুরু হয় কলাবাগান থেকে। বাস ১১টায় ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও ঢাকার বিখ্যাত জ্যাম এর কারণে যাত্রা শুরু হয় 12 টা 15 মিনিটে। জ্যামের কারণে শুরুতে প্রচন্ড বিরক্ত হচ্ছিলাম, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে এই ইট কাঠের জঙ্গল আর জ্যাম পিছনে ফেলে প্রকৃতির কোলে গিয়ে ঠাঁই নিব ভেবে ভালোও লাগছিল। আধো ঘুম আর আধো জাগরণে রাতটা পার করে দিলাম। একটা যাত্রা বিরতি আর কর্ণফুলী সেতুর কাছে জ্যামে ঘণ্টা খানেক বাস ঠায় দাড়িয়ে থাকা ব্যতীত রাত ছিল ঘটনাবিহীন। কিন্তু সকালে সূর্য উঠার সাথেসাথেই চোখ থেকে ঘুম পালালো। শীতের ঘন কুয়াশা ভেদ করে সকালের সোনা রোদ, নতুন নতুন লোকালয় আর মাঠ ঘাট দেখতে দেখতে মনের অবসাদ নিমিষেই কেটে গেল।

চকরিয়া পৌঁছলাম আমরা সকাল 9টায়। নাস্তার প্রতি একজনেরও খুব একটা আগ্রহ না থাকায় তখনই আলীকদম এর উদ্দশ্যে রওনা দিবো ঠিক করলাম। 9টা 55 তে একটা বাস যাবে আলীকদম, কিন্তু আমরা লোকাল জীপ এ যাওয়ার জন্য টিকিট করি। জীপ সম্পূর্ণ ভর্তি হতে হতে বাজে 9টা 45। তিন জনের সিট এ 4 জন গাদাগাদি করে বসে রওনা দেই আমরা। 10 মিনিট চলার পরই আমরা পাহাড়ি আঁকাবাঁকা আর উঁচুনিচু রাস্তায় এসে পরি। বান্দরবনের বিশেষত্ব ভয়ানক সব বাঁক, রাস্তার পাশেই বুকে কাপন ধরানোর মত গভীর খাদ আর নির্জন প্রকৃতি – সব ই ছিল এই পথে। আর যেখানে খাদ ছিল না সেখানে ছিল রাস্তার পাশে প্রচুর পরিমাণে তামাক ক্ষেত।

প্রায় এক ঘন্টা পর আমরা পৌঁছে যাই আলীকদম বাজার। স্টেশনের পাশেই একটি হোটেলে আমরা দুপুরের খাবার খেয়ে নিই। খাবারের মান আহামরি কিছু না হলেও খারাপ ছিল না। ভরপেট খেয়ে আমরা রওনা দেই সুরঙ্গের উদ্দেশ্যে। হোটেলের মালিক কে রাস্তা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে উনি নিজেই একটি ব্যাটারী চালিত রিকশা ঠিক করে দেন আমাদের। আমরা ঐ দোকান থেকেই কিছু ভাজা পোড়া কিনে নিই পথে খাওয়ার জন্য। ১৫ মিনিটেই আমরা পাহাড়ের ধার ঘেঁষে বয়ে চলা ছোট নদীটির তীরে পৌঁছে যাই যেখান থেকে আমাদের ট্র্যাকিং শুরু হয়। আমরা অটো সম্পূর্ণ সময়ের জন্য রিজার্ভ না করে ড্রাইভারের মোবাইল নাম্বার নিয়ে নিই যেন ফেরার পথে তাকে কল করলে তিনি আবার এসে আমাদের নিয়ে যেতে পারেন। নদীর তীরের ছোট দোকানটিতে আমরা আমাদের ব্যাগ জমা রাখি, অটো ড্রাইভারের পরামর্শে আমরা কোন গাইড ছাড়া আর খালি পায়ে রওনা দেই সুড়ঙ্গের উদ্দেশ্যে।

শুরুতেই হেঁটে নদীটি পার হতে হয়। শীতে এতে হাঁটু পানি থাকলেও বর্ষায় পানি বেড়ে যায়, তখন নৌকা লাগে পার হতে। এখন অবশ্য নদীটির উপর একটি ব্রিজ হচ্ছে, আর নদীর ওপারেও নাকি রিসোর্ট হবে শুনলাম। তবে হেঁটে হেঁটে নদীর ঠাণ্ডা হাঁটু জল পার হওয়ার অনুভূতি ছিল অসাধারণ। আমাদের এত ভাল লাগছিল যে আমরা প্রয়জনের চেয়ে বেশকিছুটা সময় বেশিই নিই পার হতে। তারপর অল্প একটু পিচ্ছিল পাহাড়ি পথ পাড়ি দেয়ার পর আসে দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে চলা ঝিরি পথ। এই পাহাড়ে ছোট ছোট পাহাড়ি ছরা থাকায় এই পথটা সবসময় ভেজা থাকে আর জায়গায় জায়গায় পানি জমে থাকে। মাঝে মাঝে পথ এত সরু হয়ে যাচ্ছিল যে পা রাখার জায়গা পাওয়া যাচ্ছিল না। মাঝে মাঝে দুই পাশের পাহাড়ে হাতের ভর দিয়ে চলা লাগছিল। আমরা যতই ভিতরে যাচ্ছিলাম ততই এডভেঞ্চারের একটা অনুভূতি আসছিল। কোথাও কোথাও পাহাড়ের উপরে থাকা গাছের ফাঁক গলে সূর্যের আলোর রেখা এসে পরছিল, দুই পাশে হাতের নাগালেই স্যাঁতস্যাঁতে, সবুজ পাহাড়। আবার কোথাও মসৃণ পাহাড়ের গায়ে ভিন্ন ভিন্ন রকমের মাটির পরদ। মোটকথা কিছু সময়ের জন্য যেন ভুলে গিয়েছিলাম আমরা কোন শতাব্দীর বাসিন্দা। এভাবেই ২০-২৫ মিনিট হাঁটার পর রাস্তা দুই ভাগ হয়ে দুই দিকে চলে যায়। ডানের রাস্তা দিয়ে আরও মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই আলির সুড়ঙ্গ। সুরঙ্গতে উঠা বেশ চ্যালেজিং। হালকা কিছু কসরতের পর আমরা মূল সুড়ঙ্গে উঠতে সমর্থ হই। সুড়ঙ্গের আঁধারে কিছু সময় কাটিয়ে আমরা দ্বিতীয় সুড়ঙ্গের পথ ধরি।

পাহাড়ের আরেকটু গভীরে ২য় সুড়ঙ্গ। কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর আগেই আমরা থমকে দাঁড়াই। এবারে উপরে ওঠা আরও অনেক বেশি কঠিন। মোটা একটি গাছে কিছু বাঁশ পেরেক দিয়ে আটকানো আর একটি রশি ঝোলানো। এর মাধ্যমেই উঠা লাগবে। তার উপর পানি আর কাদায় সব পিচ্ছিল হয়ে আছে। দেখেই বন্ধু উঠার চিন্তা বাদ দেয়। কিন্তু আমি ভাবলাম চেষ্টা করতে দোষ কি? যদিও উঠতে পারব না সিওর তাও দেখি কতটুকু পাড়ি। এটা ভেবে একটু উঠলাম, তারপর আর নামতে মন চাইল না তাই পুরোটাই উঠে গেলাম। বন্ধু নিচে অপেক্ষায় রইল। আর আমি এগিয়ে চললাম সামনে। এই গুহার মুখ একদম ছোট, মাটিতে একটা গর্তের মত। তাই এর বেশি ভিতরে আর গেলাম না। বরং ঐ পথ ধরে আরও সামনে এগিয়ে গেলাম। সেখানে খুব ছোট একটি পাহাড়ি ছরা পেলাম। সেই ছরা থেকে পানি পড়ার শব্দ ছিল অসাধারণ। এই ট্র্যাকিং এর সবথেকে পরিতৃপ্তিকর মুহূর্ত ছিল তা। যতই ভিতরের দিকে যাচ্ছিলাম ততোই মনে হচ্ছিল দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরছি, কিন্তু পৃথিবীর আরও সান্নিধ্যে যাচ্ছি। যেন নিজেকে হারিয়ে আবার নতুন করে পাওয়া। বিপরীতধর্মী দুটি অনুভূতি একসাথে মিলে অনন্য এক শিহরণ জাগাচ্ছিল মনে। আরও একটু সামনে এগুনোর পর পথ আরও অনেক দুর্গম হয়ে পড়ায় ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।

একই পথে আবার আমরা ফিরে আসি নদীর পারের সেই দোকানে। সেখান থেকে নাস্তা সেরে ব্যাগ নিয়ে রওনা দিই চকরিয়ার উদ্দেশ্যে। পরের গন্তব্য কুতুবদিয়া…

দ্রুশ্তব্যঃ
১। অনেককেই দেখলাম নিজের সাথে জোর করে এসব জায়গায় যাচ্ছেন। যেখানেই যান দয়া করে নিজের নিরাপত্তার দিকে খেয়াল রাখবেন। এসব জায়গায় ব্যথা পেলে বা পরে গেলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা খুবই দুরহ হবে।
২। নিজের সামর্থ সম্পর্কে জানুন। কাউকে দেখানোর জন্য সামর্থের বাইরে কিছু করতে যাবেন না।
৩। কেউ কেউ দেখলাম কেউ যেতে না চাইলেও জোর করছেন, বা বিদ্রুপ করছেন। দয়া করে এসব থেকে বিরত থাকবেন। এখানে কাউকে প্রমানের বা দেখানোর কিছু নেই।
৪। এখানে গেলে উপযুক্ত কাপড় আর জুতা পরে আর মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে যাবেন। কয়েকজনকে দেখলাম স্যুট কোট পরে গিয়েছেন তারপর নদীর তীর থেকেই তাদের ফিরে আসতে হয়েছে।
৫। এটি একটি শান্তিপূর্ন জায়গা। অযথা জোরে কথা বলে বা চীৎকার করে নির্জনতায় বিঘ্ন ঘটাবেন না।
৬। যেখানেই যাবেন পরিবেশের ক্ষতি করবেন না, যেখানে সেখানে প্লাস্টিক, ময়লা ফেলবেন না।

Leave a Comment

0 Shares
Tweet
Share
Share
Pin